সকল আমল নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল

আমীরুল মু’মিনীন আবু হাফসা উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ

রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। সুতরাং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দিকে হিজরাত করবে তার হিজরাত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হবে। আর যে ব্যক্তি হিজরাত করবে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে, কিংবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, তাহলে তার হিজরাত হবে সেই দিকে যেদিকে সে হিজরাত করল। -বুখারী, মুসলিম।

রাবী হাদীস তথা বর্ণনাকারীঃ

হাদীস টি বর্ণনা করেছেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা। আবু হাফস হল তাঁর উপনাম। তাঁর পিতার নাম ছিল খাত্তাব ইবনু নুফাইল এবং মাতার নাম ছিল হানতমা বিনতে হাশেম। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নুবুওয়াত লাভের ত্রিশ বছর পূর্বে তিনি পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন। জাহেলী যুগে কুরাইশদের দূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে সফর করেন। ইসলামের শুরু শুরু অবস্থায় তিনি ইসলামের খুব বিরূদ্ধে ছিলেন। হিজরাতের পাঁচ বছর পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ করাটা মুসলমানদের জন্য বড় ধরণের বিজয় ছিল। ১৩ হিজরী সনে তিনি খলীফাতুল মুসলিমীন নিযুক্ত হলেন। প্রায় সাড়ে দশ বছর পর্যন্ত খেলাফতের মহান দায়িত্ব আদায় করার পর ২৩ হিজরী সালে আবুল’লু নামক এক অগ্নিপুজকের চুরিকাঘাতে আহত হয়ে শাহাদত বরণ করেন।

তাখরীজুল হাদীসঃ

সহীহ বুখারী, হা/নং (১, ৬১৯৫, ৬৪৩৯) সহীহ মুসলিম, (৩৫৩, ১৯০৭) সুনান তিরমিযী (১৫৭১) নাসায়ী, (৭৪, ৩৩৮৩, ৩৭৩৪) মুসনাদু আহমদ, (১৬৩) সুনান বায়হাকী (২/১৪, ৪/১১২, ৫/৩৯) তাহযীবুল আছার-ত্ববরী, (৮৯০, ৯১০) শুআবুল ঈমান -বায়হাকী, (৬৫৬৯) দারাকুতনী, (১৩৪), সহীহ ইবনু খুযাইমা, (১৪৩) মুশকিলুল আছার-ত্বাহাবী, (৪৪৬৬)। এছাড়া আরো অনেক মুহাদ্দিস তাদের নিজ নিজ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

শাব্দিক ব্যাখ্যাঃ

‘ইন্নামা’ শব্দটি আরবী ভাষায় সীমাবদ্ধতা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘আল আমাল’ বলতে যে কোন আমলকে বুঝায়। সেটি যাহেরী তথা স্পষ্ট হোক বা বাতেনী তথা অস্পষ্ট। ‘নিয়্যাত’ শব্দের অর্থ হল,অন্তরের সংকল্প,ইচ্ছা বা ইরাদা। সুতরাং নিয়ত একটি আন্তরিক কাজ মুখে উচ্চারণ করা না করার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। ‘হিজরাত’ শব্দের অর্থ হল,ত্যাগ করা,ছেড়ে দেয়া। এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। ‘দুনিয়া’ অর্থ আসমান যমীনের মধ্যে যা আছে তা সব।

হাদীসের গুরুত্বঃ

এই হাদীসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীস। ওলামায়ে কেরাম বলেছেনঃ ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারের অর্ধেক এই হাদীসে নীহিত রয়েছে।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেনঃ এই হাদীসটি জ্ঞানের এক তৃতীয়াংশ এবং ফিকাহ শাস্ত্রের সত্তুরটি বিষয় এর ভিতরে রয়েছে।

ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) বলেনঃ তিনটি হাদীসের উপর ইসলামের মৌল ভিত্তি। তা হল, উমর (রা;) এর এই হাদীস-‘সকল আমলের ভিত্তি নিয়্যাতের উপর’।–
আয়েশা (রাঃ) এর হাদীস -‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে নতুন বিষয় সংযোজন করল তা পরিত্যাজ্য’।–
আর নু’মান ইবনু বশীর (রাঃ) এর হাদীস-‘হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট’।

আবার অনেকে বলেছেনঃ এই হাদীসটি বাতেনী আমলের মাপকাঠি আর আয়েশা (রাঃ) এর হাদীসটি যাহেরী আমলের মাপকাঠি। হাদীসটির এরূপ গুরুত্বের কারণে বড় বড় হাদীস বিশারদগণ তাদের কিতাবসমূহ শুরু করেছেন এই হাদীস দ্বারা।

ব্যাখ্যাঃ

হাদীসের শব্দ দ্বারা একথা ষ্পষ্ট হয় যে, আমলের প্রতিফল পাওয়া না পাওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে আমল সহীহ শুদ্ধ হওয়া বা না হওয়া এসব কিছু নিয়্যাতের উপর নির্ভর করে। সুতরাং নিয়্যাত ভাল হলে কাজের প্রতিফল অনেক গুণ বেশী পাওয়া যাবে। আর নিয়্যাত ভাল না হলে তার ফল পাওয়া যাবেনা। নিয়্যাত ভাল হওয়ার জন্য শর্ত হল, ইখলাছ সমৃদ্ধ হওয়া।
অর্থাৎ যা কিছু করবে শুধুমাত্র আল্লাহকে রাজী খুশী করার উদ্দেশ্যে করবে। অন্যথায় সৎকাজেও কোন প্রতিদানের আশা করা যাবে না।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

‘তাদেরকে এছাড়া অন্য কোন আদেশ দেয়া হয়নি যে,তারা শুধু আল্লাহর জন্যে দ্বীনকে খালিছ করে তাঁরই ইবাদত করবে’। (সুরা বাইয়িনাহঃ ৫।)

এখানে আমরা কাজ ও নিয়্যাতের সমন্বয়কে চার ভাগে ভাগ করতে পারি।
(১) কাজও ভাল নিয়্যাতও ভাল। যেমন কেউ ছলাত (নামায) আদায় করল আল্লাহ কে রাজী করার উদ্দেশ্যে।
(২) কাজও খারাপ নিয়্যাতও খারাপ। যেমন, কেউ ডাকাতি করল মানুষকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে।
(৩) কাজ ভাল কিন্তু নিয়্যাত খারাপ। যেমন, কাউকে দান করল লোক দেখানো বা নাম কামানোর উদ্দেশ্যে।
(৪) কাজ খারাপ কিন্তু নিয়্যাত ভাল। যেমন, কেউ চুরি করল মানুষকে দান করার উদ্দেশ্যে।
এসবের মধ্যে শুধু প্রথম প্রকারকেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

বলা বাহুল্য যে, নিয়্যাতের কারণেই ইবাদত এবং আদত তথা অভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যেমন নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের খোর-পোষের ব্যবস্থা করা মানুষের স্বভাবগত অভ্যাস। কিন্তু কেউ যদি তা আল্লাহর আদেশ পালন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের অনুসরণের উদ্দেশ্যে করে, তাহলে তার এই কাজটি ইবাদতে পরিণত হবে এবং সে বক্তি প্রতিদানের অধিকারী হবে। একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়্যাত করবে’। তারপর তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে কথাটি বুঝিয়ে বলেছেন যে, ‘আল্লাহ ও রাসূলের দিকে যে ব্যক্তি হিজরাত করবে তার হিজরাত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হবে। আর যে ব্যক্তি হিজরাত করবে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে, কিংবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, তাহলে তার হিজরাত হবে সেই দিকে যেদিকে সে হিজরাত করল’। অর্থাৎ পার্থিব উদ্দেশ্য থাকলে হিজরাতের মত বড় একটি ইবাদতের প্রতিফল থেকেও সে মাহরূম হয়ে যাবে।

হিজরাত ইসলামে তিন প্রকারের ছিল।
(১) শিরকের স্থান থেকে ইসলামের স্থানের দিকে হিজরাত।
যেমন মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফের দিকে হিজরাত।
(২) ভয়ের স্থান থেকে নিরাপদ বা নির্ভয়ের স্থানের দিকে হিজরাত। যেমন মক্কা থেকে হাবশার দিকে হিজরাত।
(৩) আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা ছেড়ে দেয়া। প্রথম দুটি বর্তমান না থাকলেও শেষের বিষয়টি কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুহাজির সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াদি ছেড়ে দেয়। (বুখারী)
হিজরাতের আর একটি স্তর হল,পাপের স্থান ছেড়ে পুণ্যের স্থানে চলে যাওয়া। যদি তা সম্ভব হয়। এরূপ হিজরাত করা মুস্তাহাব।

আরও পড়ুন – 

মোট কথা,এখনো যারা হিজরাত করবে তাদের নিয়্যাত যদি ভাল হয়, তাহলে ভাল প্রতিদান পাবে। আর যদি নিয়্যাত খারাপ হয়, তাহলে প্রতিদান থেকে মাহরূম থাকবে।

নিয়্যাত যদি ভাল হয়,তাহলে কখনো কাজ না করতে পারলেও শুধু নিয়্যাতের কারণে ছাওয়াবের ভাগী হয়।যেমন নাসায়ী,ইবনু মাজাহ ও ইবনু হিব্বান তাদের কিতাবে আবুদ্দরদা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঘুমাতে আসে এবং নিয়্যাত করে যে, সে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ পড়বে। কিন্তু তার চোখ লেগে যায় এবং ফজর পর্যন্ত সে আর জাগ্রত হয়না। তাহলে সে যা নিয়্যাত করেছিল তার পরিপূর্ণ সওয়াব তাকে দেয়া হয়। (তারগীব তারহীবঃ ২১।)

বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজের নিয়্যাত করে অথচ এখনো করেনি, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে পূর্ণ এক নেকী দান করেন। (তারগীব তারহীবঃ ১৭।)

ইমাম আহমদ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ আবুকাবশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পৃথিবীর মানুষ চার রকমের হয়। (১) যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ এবং ইলম দুটিই দান করেন। সে তার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং আত্বীয়তা রক্ষা করে, সে অনেক উত্তম। (২) যাকে আল্লাহ তাআলা ইলম দান করেছেন কিন্তু সম্পদ দেন নি। সে সত্য নিয়্যাতে বলে যে, যদি আল্লাহ তাআলা আমাকেও সম্পদ দান করতেন, তাহলে আমিও অমুকের মত আমল করতাম। উভয় লোক সমান সমান সওয়াব পাবে। (তারগীব তারহীবঃ ১৬।)

ইমাম মুসলিম সাহাল ইবনু হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন,রাসূল সাসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি খালিছ নিয়্যাতে আল্লাহর কাছে শাহাদাতের মৃত্যুর আশা করবে,সে নিজের বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ তাআলা তাকে শহীদগণের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দিবেন। (মুসলিমঃ ৪৯০৭)।

এই হাদীসের ব্যাখ্যার ব্যাপারে আরো অনেক কথা রয়ে গেছে। সংক্ষিপ্ত ভাবে আমরা এখানে কিছু মাত্র উল্লেখ করলাম। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ।

Leave a Comment